ছায়াপথ কাকে বলে? ছায়াপথ, গ্যালাক্সি ও নেহারিকার মধ্যে পার্থক্য

5/5 - (1 vote)

রাতের আকাশ আমরা যে তারা দেখতে পায়। এগুলো কেবল একাকী ভাসমান নয়, বরং এগুলো দলবদ্ধভাবে থাকে। এগুলোকে ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি বলা হয়। মহাবিশ্বে এমন অসংখ্য ছায়াপথ রয়েছে।

আজকের আর্টিকেলে ছায়াপথ কাকে বলে এই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। এছাড়াও ছায়াপথ এবং নিহারিকা, ছায়াপথ ও গ্যালাক্সির পার্থক্য তুলে ধরবো।

ছায়াপথ কাকে বলে

ছায়াপথ কাকে বলে, ছায়াপথ এবং নিহারিকার মধ্যে পার্থক্যজ্যোতির্বিজ্ঞান কিংবা মহাকাশ নিয়ে যারা পর্যালোচনা করেন তাদের কাছে ছায়াপথ একটি অত্যন্ত আগ্রহের বিষয়। ছায়াপথ আসলে কী? এক কথায় বলতে চাইলে, ছায়াপথ হলো নক্ষত্র, ধূলিকণা, নক্ষত্রের অবশেষ, গ্যাসীয় বস্তু এবং বিভিন্ন আন্ত:নাক্ষত্রিক বস্তুর এক মহাসমাবেশ। 

মহাবিশ্বে এত এত নক্ষত্র, উপাদান- এই সবকিছু যদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে তবে একে অপরের সাথে সংঘর্ষ করতে পারে যার ফলে পুরো বিশ্ব এক পর্যায়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকবে। এই ক্ষয় যেনো না হয় তাই নক্ষত্রগুলোকে একটি নির্দিষ্ট পথে ধারণ করে এই ছায়াপথ। 

এই ছায়াপথকে খালি চোখেও দেখা যায়। অনেক সময়ই রাতের আকাশে হালকা একটা আলোর রেখা দেখা যায় যা অনেকটা দুধের মত রঙের। এই হালকা আলোর রেখাটিই হলো আমাদের ছায়াপথ। 

ছায়াপথে অসংখ্য তারার সমাহার থাকলেও সেগুলো আমাদের থেকে অনেক দূরে। তাই প্রতিটি তারা আলাদাভাবে দেখা সম্ভব নয়। একারণেই সবগুলো তারার আলো একসাথে এরকম আলোর রেখা সৃষ্টি করে। যার ফলস্বরূপ, আমরা আকাশে প্রতিটি নক্ষত্রকে আলাদাভাবে না দেখে একসাথে একটি রেখার মধ্যেই দেখতে পাই।

ছায়াপথ কিভাবে গঠিত হয়

ছায়াপথের গঠন নিয়ে অনেক রকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তৈরি হতে দেখা যায়। কেননা সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়েও এখনো অনেক ছায়াপথ স্পষ্টভাবে দেখা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রথম তিন মিনিটের মাঝে যে হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম মেঘ উৎপন্ন হয়েছে তা-ই ছায়াপথের আদি উপাদান।

এই হাইড্রোজের এবং হিলিয়াম মেঘের মধ্যে পরস্পরের বিক্রিয়া ঘটে। হাইড্রোজেন এক পর্যায়ের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে সংকুচিত হতে থাকে এবং এর মধ্যে তাপমাত্রা ১০ মিলিয়ন ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়ে যা হিলিয়ামে পরিণত হওয়ার পর ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে এক একটি নক্ষত্রের সৃষ্টি করে। 

এভাবেই একটি সুসজ্জিত ছায়াপথ গড়ে ওঠে। আর প্রতিটি ছায়াপথই তার নির্দিষ্ট ভরকেন্দ্র অনুযায়ী অর্থাৎ এর আশেপাশে আবর্তিত হতে থাকে। তবে এক্ষেত্রে বিক্রিয়ার তারতম্যের কারণে ছায়াপথের আকৃতিতে পরিবর্তন আসে। একারণেই আমরা সাধারণত তিন ধরণের ছায়াপথ দেখতে পাই-

  • সর্পিলাকার
  • উপবৃত্তাকার
  • অনিয়তাকার

এখানে উল্লেখ্য যে সর্পিলাকার এবং উপবৃত্তাকার ছায়াপথই আমরা বেশি দেখতে পাই। আর অনিয়তাকার ছায়াপথ তাদের গঠনের এক পর্যায়ে অথবা কোনো দিকে বিস্তৃত বা বর্ধিত হয়ে সর্পিলাকার কিংবা উপবৃত্তাকার আকৃতি ধারণ করে। তাই অনিয়তাকার ছায়াপথের সংখ্যা বাকি দুটোর থেকে কম।

ছায়াপথ এবং গ্যালাক্সির মধ্যে পার্থক্য

ছায়াপথ কাকে বলে, ছায়াপথ এবং নিহারিকার মধ্যে পার্থক্য

ছায়াপথ এবং গ্যালাক্সি একই কিনা এই প্রশ্নটি নিয়ে দ্বিধা অনেকেরই। কারণ এই দুটি বিষয় দিয়ে একই ধারার উপাদানই বোঝায়। তবে এর মাঝেও কিছুটা সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে যা সার্বিক আলোচনায় অনেক সময় বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু ছায়াপথ এবং গ্যালাক্সিকে পুরোপুরি একই বলা যাবে না।

সংক্ষেপে বলতে হলে, ছায়াপথ হলো গ্যালাক্সির ক্ষুদ্রতম অংশ। বিষয়টি নিয়ে একটু বিষদ বিশ্লেষণ করা যাক। গ্যালাক্সি বলতে বোঝায় নক্ষত্র, ধূলিকণা, গ্রহ, উপগ্রহসহ মহাবিশ্বের বিভিন্ন উপাদানের সমাহার। বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্র একটি গ্যালাক্সিতে থাকতে পারে এবং এই সব মিলে একটি ক্লাস্টারের মত গঠিত হয়। 

অন্যদিকে, ছায়াপথ হলো এমন একটি সিস্টেম যা বিভিন্ন নক্ষত্র এবং আন্ত:নাক্ষত্রিক উপাদানগুলোকে একটি সুসজ্জিত পথে ধারণ করে। কোটি কোটি নক্ষত্রগুলোকে তাদের নক্ষত্রমন্ডল নিয়ে সুর্নিদিষ্টভাবে আবর্তন করার প্রক্রিয়াকে ধারণ করে ছায়াপথ। তাই ছায়াপথ এবং গ্যালাক্সি একই ধারার হলেও, সম্পূর্ণরূপে এক নয়।

ছায়াপথ এবং নীহারিকার মধ্যে পার্থক্য 

ছায়াপথ কাকে বলে, ছায়াপথ এবং নিহারিকার মধ্যে পার্থক্য

গ্যালাক্সি এবং ছায়াপথের মধ্যে যে ন্যুনতম একটি পার্থক্য রয়েছে তা আমরা ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছি। তবে ছায়াপথের সাথে আরও একটি বিষয়ের দ্বন্দ্ব দেখা যায়, আর তা হলো নীহারিকা। অনেকেই মনে করেন হয়ত এই দুটো একই। তবে না, ছায়াপথ এবং নীহারিকা সম্পূর্ণ আলাদা।

নীহারিকা হলো প্রকৃতপক্ষে একটি আলোকিত অংশ বা অঞ্চল যেখানে ধূলো, গ্যাসসহ বিভিন্ন আন্ত:নাক্ষত্রিক পদার্থ থাকে। এই অঞ্চলগুলোতে বিভিন্ন উপাদান ক্রমান্বয়ে সঞ্চিত হতে থাকে এবং এই সঞ্চরণের এক পর্যায়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রের সৃষ্টি হয়। নক্ষত্র গঠনকারী উপাদানগুলো এই অঞ্চলগুলোতে থাকার কারণে এটি আলোকিত থাকে।

অন্যদিকে, ছায়াপথ সম্পর্কে তো আমরা ইতিমধ্যে জেনেই গেছি যে তা নক্ষত্র এবং এসকল পদার্থের সমাহার। এ থেকে বোঝা যায়, এই দুটো ধারণায় যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। তাহলে কেনো এদের নিয়ে ভুল হয়?

বিশেষত, এর কারণ অস্পষ্টটা। নীহারিকা গুলো উজ্জ্বল বা আলোকিত হলেও তা পৃথিবী থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। তারা আকারে অনেক বড় যা শত শত আলোকবর্ষ ব্যাস সম্বলিত। কিন্তু দূরত্বের কারণে এদের পৃথিবী থেকে খালি চোখে দেখা যায় না সচরাচর।  

সবচেয়ে বড় নীহারিকা যার নাম, ওরিওন নেবুলা, এটিও পৃথিবী থেকে খালি চোখে অত্যন্ত ক্ষীণ দেখায়। আর ছায়াপথও অস্পষ্ট আলোর রেখার মত দেখা যায়। একারণেই খালি চোখে অনেকেই নীহারিকা এবং ছায়াপথ একই মনে করে ভুল করেন।

পৃথিবী কোন ছায়াপথে অবস্থিত

ছায়াপথ সম্পর্কে জানার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দাঁড়ায় আমরা বা আমাদের পৃথিবী কোন ছায়াপথে অবস্থিত। আর এই প্রশ্নের উত্তর হলো আকাশগঙ্গা ছায়াপথ।

রাতে অনেক সময় আকাশে যে দুধের মত হালকা সাদা আলোর রেখা দেখা যায় সেটাই হলো আকাশগঙ্গা ছায়াপথ। প্রায় বিশ লক্ষ আলোকবর্ষ ব্যাস সম্বলিত এই সর্পিলাকার ছায়াপথটি ভার্গো সুপার-ক্লাস্টার এর অংশ। এতে নক্ষত্র রয়েছে প্রায় ২০০-৪০০ বিলিয়ন।

📌 আরো পড়ুন 👇

আমাদের পৃথিবী এই ছায়াপথের “ওরিয়ন আর্ম” বাহুর অভ্যন্তরে অবস্থিত যা গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে প্রায় ২৭০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। ধারণামতে আকাশগঙ্গা ছায়াপথের সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ৬.৫ থেকে ১০.১ বিলিয়ন বছর আগে। এতে যেমন অঢেল নক্ষত্র রয়েছে, তেমনি বহু গ্রহ এবং উপগ্রহও রয়েছে।

ছায়াপথ সম্পর্কিত কিছু প্রশ্নউত্তর

আমাদের সবচেয়ে কাছের ছায়াপথের নাম কি?

আমাদের পৃথিবী আকাশগঙ্গা ছায়াপথে অবস্থিত। আর এই ছায়াপথের সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থান করছে অ্যান্ড্রোমিডা ছায়াপথ। শুধু তাই নয়, স্থানীয় ছায়াপথগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে বড়। পৃথিবী থেকে অ্যান্ড্রোমিডা ছায়াপথের দূরে ২.৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ। এর আশপাশে অনেকগুলো ছোট ছায়াপথ বিদ্যমান।

আকাশগঙ্গা ছায়াপথ নামে কেনো ডাকা হয়?

দুধের মত হালকা সাদা রঙের আলোর রেখা দেখা যায় বলেই এর নামকরণ করা হয় আকাশগঙ্গ। পররবর্তীতে অবশ্য বাংলায় ছায়াপথের সাধারণ নাম হিসেবে এটাই নির্ধারণ করা হয়। রাতের পরিষ্কার আকাশে এটি সবচেয়ে উজ্জ্বল হিসেবে দেখা যায়।

সকল ছায়াপথের কেন্দ্রে কি কৃষ্ণ গহ্বর বিদ্যমান? 

না। মহাবিশ্বের সকল ছায়াপথের কেন্দ্রে কৃষ্ণ গহ্বর নেই। তবে বেশ কিছু ছায়াপথেরই রয়েছে। যেমন আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কৃষ্ণ গহ্বর রয়েছে যার নাম “ধনু-এ”। এই গহ্বরগুলো বিভিন্ন পদার্থ বিলীন করে নিতে পারে নিজের মধ্যে যা বিজ্ঞানীদের গবেষণায় পাওয়া গেছে।

মেঘযুক্ত আকাশে কি ছায়াপথ দেখা যাবে? 

না, ছায়াপথ দেখতে হলে আকাশ একেবারে মেঘমুক্ত এবং পরিষ্কার থাকতে হবে। মেঘলা দিনে ছায়াপথের ছবি মেঘের আড়ালে ঢেকে যায়। আর মেঘমুক্ত দিনে আকাশ পরিষ্কার থাকলে অমাবস্যার রাতে ছায়াপথ দেখা যায়।

ছায়াপথ সম্পর্কে আমাদের মতামত

ছায়াপথ মহাবিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যালোচনার কেন্দ্রবিন্দু। এই রহস্যময় অন্তরীক্ষে আমরা কীভাবে থাকছি এবং আমাদের আশপাশে কোন কোন বস্তুর অস্তিত্ব রয়েছে তা জানতে হলে ছায়াপথের বিশ্লেষণ অপরিহার্য। 

এই ছায়াপথই বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্রকে ধারণ করে। আবার একইসাথে, বিভিন্ন আন্ত:নাক্ষত্রিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নক্ষত্র তৈরির প্রক্রিয়া ক্রমাগত চলমান রাখে। এ কারণেই ছায়াপথের বিস্তৃতি এবং আকৃতিতে ক্রমাগত পরিবর্তন। তাই তো বিজ্ঞানী গ্যালিলিও এর সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানীগণ নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে এই মহাকাশ সম্পর্কিত আরও আশ্চর্য তথ্য জোগাড়ে।

সম্পর্কে আপনাদের আর কোন প্রশ্ন থাকলে আমাদেরকে অবশ্যই কমেন্টের মাধ্যমে জানান। এবং সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এমন আরো শিক্ষামূলক আর্টিকেল পড়তে আমাদের ওয়েবসাইটটি ভিজিট করুন।

Sharing is Caring

Leave a Comment